
মনির মোহাম্মদ, একজন তরুণ লেখক। ছোটবেলায় এক ঈদে নিজের বাবার কাছে কেমন বায়না করেছিলেন এবং তাঁর বাবা কতটুকু ত্যাগ স্বীকার করে সে আবদার পূরণ করেছিলেন তাই জানান মনির মোহাম্মদ। তিনি বলেন, তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। ঈদের আগেরদিন আবদার করলাম সাদা বেলি কেডস এর। শুধু বেলি কেডস দিলেই হবে না, জুতোর পেছনে বাতি লাগবে। মন খারাপ করে থাকতে থাকতে একসময় জীবনের প্রথম এবং শেষবারের মত ভাত অনশনে বসলাম। সব খাওয়া যাবে শুধু ভাত খাওয়া যাবে না। সকাল গড়িয়ে বিকেল হয়ে এল আমি ভাত খাইনা। এদিকে কালো ফিতা ওয়ালা বাটা কোম্পানির চপ্পল আমার জন্য আগেই কেনা হয়ে গেছে।
কী করা যায় আব্বার কপাল জুড়ে চিন্তার রেখা। ছেলে তাঁর ভাত খায় না। তখনকার সময় যোগাযোগ ব্যবস্থাও এত ভাল ছিল না। ব্রহ্মপুত্র নদের উপরে ব্রীজের কথা কল্পনাও করেনি তখন। কয়েক মাইল হেঁটে রিক্সা নিয়ে বাস স্ট্যান্ডে যেতে হয়। বাসও মাশাল্লাহ সেই গতিতে চলে, ৩০ কিলো যেতে তিন ঘন্টা লাগিয়ে দেয়। তার উপর ফেরি পাড় হয়ে সদরে আসতে হয়। অবশেষে দাদাজানের কথায় আব্বা সেই বিকালেই ময়মনসিংহ সদরে চলে গেলেন। সেদিন আর ফিরতে পারেননি।
ঈদের দিন সকাল বেলা আব্বা হাতে একটি ব্যাগ নিয়ে ফিরলেন সাথে ছিল স্বপ্নের বেলি কেডস। কী আনন্দ! কাউকে বোঝানো যাবে না। মনে হচ্ছে নীল আসমানের বুক চিরে এক খন্ড সাদা মেঘ এনে আমার হাতে দিলেন। শুভ্র ভালোবাসায় মাখামাখি আমার কল্পনার পৃথিবী।
মনির মোহাম্মদ আরও বলেন, আব্বার ক্লান্তি জমানো মুখটি এখনও মনে আছে। আব্বা এখনও সেই গল্প করেন আর আমি অনুভব করি ক্লান্তিমাখা পিতার স্নেহ। আজ নিজে পিতা হয়ে সেটি আরও তীব্রভাবে অনুভব করছি। বাবারা আসলেই অন্যরকম।
আবৃত্তি শিল্পী আলমগীর ইসলাম শান্ত। তিনি স্মৃতিচারণ করে বলেন, ঈদের দিনের একটা ঘটনা আমার খুব মনে পড়ে – তখন আমি সম্ভবত ক্লাস ফোরে পড়ি। ঈদের আগে আগে সাধারণত আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য নতুন জামা কাপড় কেনা সহজ ছিলো না। তাই পালা বদল করেই আমাদের নতুন জামা কেনাকাটা করতে হতো কোনো কোনো বছর। সে বছরে আমার নতুন জামা কিনে দেবার পালা এসেছিল। কিন্তু আব্বার কাছে সে বছরে নতুন জামা কেনার মতো টাকা ছিলো না। আমার ছোটমন, কিছুতেই মানতে পারছিল না। যদিও আমি আর জোর করি নি সেবার নতুন জামার জন্য। আব্বা আমাকে খুব স্নেহ করতো। তাই জামা কেনার সামর্থ্য না থাকলেও পঞ্চাশ টাকার একজোড়া নতুন জুতো কিনে দিয়েছিল। খুব আনন্দ পেয়েছিলাম নতুন জুতোজোড়া পেয়ে। দূর্ভাগ্যবশতঃ ঈদের দিনই নতুন জুতো জোড়ার একটি হারিয়ে যায়। খুব কান্না পাচ্ছিলো আর সেই ঈদের দিনই অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে ছিলাম জুতো না খুঁজে পেয়ে। কি করে আমি মুখ দেখাবো আব্বাকে, ভেবে পাই না। এত অভাবের সংসারে আব্বা আমার জন্য নতুন জুতো কিনে দিয়েছে আর আমি প্রথম দিনেই তা হারিয়ে ফেলেছি। এদিকে আমার খোঁজে পুরো এলাকা-মহল্লা তোড়জোড় করে ফেলছে আমার আব্বা। আমার কোনো হদিস না পেয়ে আব্বা সেবার খুব ভয় পেয়েছিল বোধহয়। যখন রাতে আমি বাড়িতে যাই আর আব্বার মুখোমুখি হই, আব্বা আমাকে পরম স্নেহভরে বুকে জড়িয়ে ধরে হু হু করে কেঁদে উঠলেন। আমিও কিছু বুঝে উঠবার আগেই কেঁদে ফেললাম আব্বার বুকে মুখ গুঁজে। ঐ একবারই আমি আমার আব্বাকে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলাম। বহু দিন বহু বছর হয় আব্বাকে জড়িয়ে ধরি নি। আব্বা, তোমাকে একবার জড়িয়ে ধরতে চাই।
বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মোঃ আব্দুর রহমান। ঈদে বাড়ি ফেরার আগে কথা হয় তার সাথে৷ তিনি বলেন, খুব ছোটবেলায় ইদে বাবা-মায়ের কাছ থেকে পাওয়া পাঁচ-দশ টাকার যে সুখ, তা বড় হয়ে পাঁচ-দশ কোটি টাকাতেও মিলেনা। ইদে হাজার বায়না করে পাওয়া একটা ড্রেসের যে সুখ, বড় হবার পর আলমারি ভর্তি কাপড়ে সেই সুখের সিকিভাগও মিলেনা। চাইলেই কুরবানী দিতে না পারার অসামর্থ্যে যে সুখ, সেই সুখ বড় হয়ে এক-দুইটা গরু কুরবানীতেও পাওয়া যায় না। সত্যিই পাওয়া যায়না। চাইলেই কিনতে না পারার দিনগুলিই আমাদের জীবনের সবচাইতে সুন্দর দিন। ছোট কিছুতে সুখী হওয়ার ক্ষমতা যত কমে, জীবনে অপ্রাপ্তি ও দুঃখ তত বাড়ে। একসময় পুরো পৃথিবী হাতের মুঠোয় পেয়ে গেলেও আমাদের মনে হয়, কিছুই তো পাইনি এ জীবনে! প্রাপ্তি যত বাড়ে, প্রাপ্তির সুখ তত কমে। আসলে বড় হয়ে যাওয়ার মতো বড় অসুখ পৃথিবীতে আর নেই।
ত্যাগের মহিমায় ধনী-গরিব ভেদাভেদ ভুলে একসাথে ঈদ উদযাপন হোক এমনটাই প্রত্যাশা। কারো ঈদ উৎসবিহীন না হোক।
আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি জাগো বুলেটিনকে জানাতে ই-মেইল করুন- news.jagobulletin@gmail.com
