আজ ২০ জুন, বরেণ্য সাংবাদিক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অকুতোভয় সাংস্কৃতিক যোদ্ধা কামাল লোহানীর মৃত্যুবার্ষিকী। প্রগতিশীল ছাত্রনেতা, ভাষাসংগ্রামী, বিপ্লবী রাজবন্দি, তেজোদীপ্ত এ সাংবাদিক গত বছরের এই দিনে মারা যান।
কামাল লোহানীর জন্ম ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার সোনতলা গ্রামে। তার পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। বাবা আবু ইউসুফ মোহাম্মদ মুসা খান লোহানী। মা রোকেয়া খান লোহানী। শৈশবেই মা-কে হারানোর পর কলকাতায় ফুপুর বাড়িতে এবং পরবর্তীকালে চাচার কাছে পাবনায় বেড়ে ওঠেন তিনি।
কলকাতায় শিশু বিদ্যাপীঠে কামাল লোহানীর পড়াশোনায় হাতেখড়ি। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে পাবনা চলে আসেন তিনি। ভর্তি হন পাবনা জিলা স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে। ১৯৫২ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে। এই কলেজ থেকেই উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। তরুণ বয়সেই কলজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে বিজয়ী হন তিনি।
১৯৫২ সালে রাজনীতিতে তার হাতেখড়ি ১৬ বছর বয়সে, রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। কলেজে অধ্যয়নকালে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক ছাত্র আন্দোলনে শামিল হন তিনি। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের পাবনা সফরের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও মুসলিম লীগ সম্মেলন ভণ্ডুল করে দিয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি এবং প্রথমবারের মতো গ্রেফতার হন।
এ পথ মসৃণ নয় জেনেও তিনি ১৯৫৪ সালে সাধারণ নির্বাচনে নবগঠিত যুক্তফ্রন্টের হয়ে কাজ করতে গিয়ে পুনরায় গ্রেফতার হন। এই কারাবাসের সময়ে তিনি কমিউনিস্ট ভাবাদর্শে দীক্ষিত হন এবং আজীবন সেই আদর্শে অবিচল ছিলেন। ১৯৫৫ সালে পুনরায় গ্রেফতার হলে তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ প্রমুখের সঙ্গে একই জেলকক্ষে বন্দিজীবন কাটান। সেই বন্দি দিনগুলোতে তিনি বঙ্গবন্ধুর আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বে মুগ্ধ হন এবং তাঁর স্নেহসান্নিধ্যে আসেন।
১৯৬০ সালে কামাল লোহানী বিয়ে করেন তার চাচাতো বোন দীপ্তি লোহানীকে। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে অধ্যয়নকালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের কর্মী এবং আন্দোলনের সাথি ছিলেন স্ত্রী দীপ্তি লোহানী। দীপ্তি লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের একজন শব্দসৈনিকও ছিলেন।
১৯৬২ সালের ছাত্র আন্দোলনের সময় সাংবাদিক হিসেবে তিনি পরিচিতি লাভ করেন। সংসার, পেশা আর সক্রিয় রাজনীতি নিয়ে তার সময় পার হচ্ছিল তখন। মুসলিম লীগবিরোধী আন্দোলন, ছয় দফা, ১১ দফা আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে তাঁর সক্রিয় অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে, মাতৃভূমির মাটিকে শোষণমুক্ত করে স্বাধীনতা উপহার দিতে তিনি কতটা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।
১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ডাক দেন। এরই ধারাবাহিকতায় দেশকে দখলদারমুক্ত ও মুক্তিফৌজকে সহযোগিতা এবং পূর্ব পাকিস্থানের জনগণকে উজ্জীবিত রাখতে ভারত সরকার, সংস্কৃতি ও বেতারকর্মীদের সম্মিলিত প্রয়াসে গঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। এ বেতার কেন্দ্রের সংবাদ বিভাগের দায়িত্ব পালন করেন কামাল লোহানী।
জীবনযাপনে খুব সাদামাটা-সাধারণ একজন মানুষ ছিলেন কামাল লোহানী। তার পোশাক-পরিচ্ছদে কোনো বাহুল্য কখনই ছিল না। একছাঁটের লম্বা ঝুলের সাদা পাজামা-পাঞ্জাবী তার একমাত্র পরিধেয়। স্যুট-কোট পরতে হবে বলে একবার রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে বিদেশে যেতেও অস্বীকৃতি জানান তিনি।
ঢাকায় ১৯৫৫ সালে দৈনিক মিল্লাত- এ সাংবাদিকতার মধ্য দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন কামাল লোহানী। পরবর্তীকালে তিনি বিভিন্ন সময়ে দৈনিক আজাদ, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক পূর্বদেশ, দৈনিক বার্তা-সহ বিভিন্ন সংবাদপত্রে গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত ছিলেন। তিনি সাংবাদিক ইউনিয়নে দু-দফায় যুগ্ম-সম্পাদক এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি হন। তিনি গণশিল্পী সংস্থার সভাপতি ছিলেন। ১৯৬২ সালে স্বল্পকালীন কারাবাসের পর কামাল লোহানী সদ্যগঠিত সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রায় সাড়ে চার বছর এ দায়িত্ব পালন করেন তিনি।
তার জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিল সংস্কৃতিচর্চা। পঞ্চাশের দশকে সংস্কৃতি সংসদের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা গড়ে ওঠে তার। বুলবুল ললিতকলা একাডেমি, রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন কমিটি, ছায়ানট প্রভৃতি প্রথম সারির সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকাণ্ডে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন তিনি। নকশী কাঁথার মাঠ, শ্যামা, ক্ষুধিত পাষাণ নৃত্যনাট্যে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেন তিনি।
মার্কসবাদী আদর্শে ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন রাজনৈতিক আদর্শে সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘ক্রান্তি’। ক্রান্তির সবচেয়ে বড় সম্পদ তার গণসঙ্গীত। ১৯৬৭ থেকে ১৯৭১ সালের বাঁধভাঙা তুমুল গণআন্দোলনের দিনগুলোতে ক্রান্তিসহ তিনি বাংলার হাটে-মাঠে গণসঙ্গীত গেয়ে উজ্জীবিত করেছেন এদেশের মানুষকে। এর উদ্দেশ্যই ছিল বাংলার নিপীড়িত মানুষকে অভয় দেয়া।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের তৎপরতায় বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রের প্রথম পরিচালক হিসেবে ঢাকায় নিয়োগপ্রাপ্ত হন কামাল লোহানী। ১৯৭৩ সালে তিনি ফিরে আসেন সাংবাদিকতা পেশায়। ১৯৮১ সালে তিনি সংবাদপত্রের চাকরি থেকে ইস্তফা দেন। এরপর নব উদ্যমে সাংস্কৃতিক আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন কামাল লোহানী।
তিনি আমাদের দেশের আরেকজন প্রথিতযশা সাংবাদিক, সাহিত্যিক, রাজনীতিবিদ ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ফয়েজ আহমেদের সঙ্গে মিলে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। কামাল লোহানী বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি ছিলেন চার বছর এবং কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সদস্য ছিলেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন দুই দফায়। কামাল লোহানী উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি ও সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
কামাল লোহানীর লেখা প্রকাশিত বইগুলো হচ্ছে- ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম’, ‘আমরা হারবো না’, ‘সত্যি কথা বলতে কি’, ‘লড়াইয়ের গান’, ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৃত্যশিল্পের বিস্তার’, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার’, ‘এদেশ আমার গর্ব’, ‘মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘যেন ভুলে না যাই’, ‘রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘দ্রোহে প্রেমে কবিতার মত’ প্রভৃতি। এছাড়াও তার ঘটনাবহুল সাংবাদিকতা জীবন সম্পর্কে তার নিজের বাণীকে লেখ্যরূপে প্রেস ইন্সটিটিউট অব বাংলাদেশ প্রকাশ করেছে ‘অগ্রজের সঙ্গে একদিন’।
২০১৫ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পদক লাভ করেন কামাল লোহানী। তিনি জাহানারা ইমাম পদক পেয়েছেন ২০০৮ সালে। কলকাতা পুরসভার দ্বিশতবর্ষ সম্মাননা পেয়েছেন তিনি ১৯৯১ সালে। প্রেস ইনিস্টিটিউট অব বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা সাংবাদিক সম্মাননা এবং রাজশাহী লেখক সংঘ সম্মাননা পান তিনি। এছাড়া ক্রান্তি শিল্পী গোষ্ঠীর ক্রান্তি স্মারক- ২০০৩, ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠীর ঋষিজ সম্মাননা ও স্মারকসহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সম্মাননা পেয়েছেন তিনি।
আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি জাগো বুলেটিনকে জানাতে ই-মেইল করুন- news.jagobulletin@gmail.com