কবি হেলাল হাফিজ। গতকাল ছিলো তার ৭৫ তম জন্মদিন।বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ৫০৫ নম্বর কক্ষে কবি ও কবির শুভাকাঙ্ক্ষীদের নিয়ে গতকাল কবির জন্মদিন পালন করা হয় এবং কবিকে নিয়ে মোহাম্মদ আলীর লেখা বই “ফুল ও ফুলকি” এর মোড়ক উন্মোচন করা হয়।
১৯৮৬ সালে কবি হেলাল হাফিজের প্রথম প্রকাশিত বই “যে জলে আগুন জ্বলে” প্রকাশিত হয়। এই বইয়ের একটি কবিতার দুটি লাইনই মূলত তাকে জনপ্রিয় বানিয়ে দেয়।
“এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।”
যেখানে লাইন দুটি এতো জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলো যে তা ঢাবির দেওয়ালে দেওয়ালে এবং সেই সত্তর দশকের মানুষদের অন্তরে বেজে চলেছিলো এবং যা এখনো তারুণ্যের শক্তি যোগায়। তার প্রকাশিত এই কাব্যগ্রন্থটির এখন পর্যন্ত ৩৩ টিরও বেশি সংস্করণ বের হয়েছে।
কবি বলেন, মাত্র ৩ বছর বয়সেই তিনি মাতৃহারা হোন। এরপর আর কখনো মাতৃস্নেহ কি সেটা তিনি বুঝেই উঠতে পারেননি। সেটা ভুলতে তিনি মানুষদের সাথে মিশে যেতে চেষ্টা করতেন। তিনি এ পাড়ায় ও পাড়ায় গিয়ে খেলাধুলা করতেন নিজেকে ভালো রাখার জন্য। কিন্ত একটু একটু করে বড় হওয়ার কালে সেই মাতৃত্বের অভাব ধীরে ধীরে তাকে গ্রাস করে ফেলতে শুরু করে।
কবি বলেন, মারাত্মক এক স্বপ্ন নিয়ে জীবন শুরু করেছিলেন। সেই স্বপ্নের ‘স’ এর নিচের ‘ব’ ফলা ছিলোনা। প্রকৃতির সঙ্গে আর কেই বা পারে।অবুঝ তিন বছরের একজন শিশুকে রেখে তার মা হারিয়ে যায়। কবি বুঝতেই পারেননি পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বেদনাটুকু অনুভব করতে পারেননি। সেখানে তার কোনো স্মৃতি নেই, ব্যাথা নেই, বেদনা নেই। তিনি প্রকৃতির বিরুদ্ধে এই প্রতিশোধও নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রতিশোধ নিতে গিয়ে জীবন যে কষ্টের সম্মুখীন হতে হলো, যে যাতনার সম্মুখীন হতে হলো তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো ক্ষমতা তার নেই।
তিনি বলেন, এই দীর্ঘ জীবনের পুরোটা তিনি কাজে লাগাতে পারেননি। তার কিছুটা তিনি অপচয়ও করে ফেলেছেন।
তিনি বলেন, “খুব কম লিখেছি বটে, কিন্তু জীবন খরচ করে লিখেছি।” কবি চেয়েছিলেন এমন একটি কাব্যগ্রন্থ রচনা করতে যেটা শুধু মেলার সময়ই মানুষের মুখে থাকবে তা নয়। তিনি এমন একটি গ্রন্থ প্রকাশিত করতে চান যেটা মেলা শেষ হওয়ার পরেও মানুষের স্মৃতিতে থাকবে, মানুষ মনে রাখবে। তিনি করে দেখিয়েছেনও তাই। তাই তার ৫০০-৬০০ কবিতা থেকে ৫৬ টি কবিতা নিয়ে লিখিত এই একটি কাব্যগ্রন্থটির এতো কপি বিক্রি হয়েছে যা ইতোপূর্বে অন্য কোনো বইয়ের হয়নি।
বাস্তব জীবনে হেলাল হাফিজ নিঃসঙ্গতাকেই বেছে নিয়েছিলেন।।তিনি বলেন, ”আমি হোটেলজীবন এনজয় করি,নিঃসঙ্গতা,নির্জনতা আমার ভালো লাগে।একাকীত্বের এই বেদনাকে আমি উপভোগ করি”।
তাইতো কবি রচনা করেছেন, ‘তুমি আমার নিঃসঙ্গতার সতীন হয়েছ’ এবং ‘নিউটন বোমা বোঝো, মানুষ বোঝো না! এর মতো জীবন্ত লাইন।
হেলাল হাফিজ ইতোপূর্বে প্রথম আলোতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, মাত্র তিনটি ঘটনা তার জীবনকে বদলে দিয়ে যায়, যা তাকে সংসার বিমুখ করে। তাকে সন্নাসী জীবন বেছে নিতে বাধ্য করে।এরপরে তিনি আর কখনো বিয়ের কথা চিন্তা করেননি। বরং লেখাকেই ভালোবেসে মানুষ জোগাতে থাকেন।
প্রথম ঘটনা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) থাকতেন তিনি। ওই দিন সন্ধ্যায় নিউমার্কেটের দিকে আড্ডা দিয়ে রাতে ফেরার পথে হলের ক্যান্টিন বন্ধ থাকায় মেডিকেল গেটের কাছে পপুলার নামের একটা রেস্টুরেন্টে খেতে যান। খাওয়া শেষে ফজলুল হক হলে তার বন্ধু হাবিবুল্লাহ এর সঙ্গে দেখা করতে যান। সেখানে আড্ডারত অবস্থায়, রাত তখন পৌনে ১০টা হবে, হঠাৎ গোলাগুলির বিকট আওয়াজ। তারা হলের ছাদে উঠে দেখেন, নীলক্ষেত, নিউমার্কেটের দিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।
পরদিন ২৭শে মার্চ সকালে ইকবাল হলে গিয়ে দেখতে পান, মাঠের মাঝখানে, এখানে-ওখানে শুধু লাশ আর লাশ। নিজের কক্ষে গিয়ে স্যুটকেস গুছিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লেন। এখান থেকে না পালালে বাঁচা সম্ভব নয়। তিনি হলের গেইটে এসে দেখেন নির্মলেন্দু গুণ দাঁড়িয়ে আছে। সে বলেছিলো ‘আমি ভেবেছি তুমি মারা গেছো, তোমার লাশ নিতে এসেছি।’ বলেই সে কবিকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠেছিলেন।
এই ঘটনা কবির হৃদয়ে ব্যাপকভাবে ছাপ ফেলল। কবির মনে হতো সেদিন যদি নিজ হলে ফিরতেন তবে তিনি বেঁচে থাকতেন না। একটা বোনাস জীবন পেয়েছেন তিনি।
এর পরের ঘটনা ১৯৭৩ সালের জুনের। ১৯শে জুন তার পিতার মৃত্যু হলো। তিন বছর বয়সে মা মারা যাওয়ার পর আব্বাই ছিলেন তার সবকিছু। তাঁর মৃত্যুও প্রবলভাবে ধাক্কা দিল কবিকে। কবির তখন মনে হলো, জগৎসংসার তুচ্ছ, সব অর্থহীন।
তার পিতার মৃত্যুর মাসখানেক পরেই ঘটলো তৃতীয় ঘটনা যা কবিকে আরো নিঃসঙ্গ জীবনের দিকে নিয়ে গেলো। কৈশোরে হেলেন নামের এক তরুণীর সঙ্গে প্রেম হয়েছিল তার।কবিতায় তার কথাও লিখেছেন তিনি। ওর সঙ্গে প্রথমে বন্ধুত্ব, ভালো লাগা, এরপর হয় দু’জনের প্রেম। সেটা ঘটেছিল নেত্রকোনাতেই। তাকে খুব পছন্দ করতো সে। সেও ভালোবাসতো তাকে। ইন্টারমিডিয়েট পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলো সে। কিন্তু হঠাৎ হেলেনের সঙ্গে আকস্মিক ব্রেকআপ হয়ে গেল তার। একদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক লাইব্রেরির একটি ভাস্কর্যের পাশে বসেছিল দু’জনে। হেলেন তাকে চমকে দিয়ে বলেছিলো, ‘আমি তো অন্য একজনকে বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাবা-মা আমার বিয়ে ঠিক করেছে।’
ছোটবেলা থেকেই সহনশীল হয়ে বেড়ে উঠা কবি সেদিন প্রচন্ড সহ্যশক্তি নিয়ে স্বাভাবিক ভাবে সেখান থেকে উঠে রিকশা নিয়ে সোজা হলে চলে আসেন।এরপরে আর কখনো তার হেলেনের সঙ্গে দেখা বা কথা হয়নি।
এই তিনটি ঘটনা কবিকে চিরস্থায়ীভাবে সংসারবিমুখ করে ফেলে। কবি বলেছিলেন, ‘আমার আর ঘর হলো না, সংসার হলো না, অর্থকড়ি হলো না, প্রতিষ্ঠা হলো না’। কিন্তু সম্ভবত তিনি মানুষ ঠিকই জুগিয়েছেন। পেয়েছেন অসংখ্য মানুষদের ভালোবাসা। তার জন্মদিনে তার দীর্ঘায়ু ও সুস্থতা কামনা করছি।
লেখকঃ শিক্ষার্থী, সরকারি তিতুমীর কলেজ
আপনার চারপাশে ঘটে যাওয়া নানা খবর, খবরের পিছনের খবর সরাসরি জাগো বুলেটিনকে জানাতে ই-মেইল করুন- news.jagobulletin@gmail.com